শনিবার, ৮ মে, ২০২১

রোমান্টিক থ্রিলার ১


 রোমান্টিক থ্রিলার


বাহিরে ল্যাম্প পোস্টের নিচে সাদা গাড়িটা দেখতে কেমন হলুদ লাগছে। থেমে আছে অনেক সময় ধরে। বারান্দায় লাগানো বেলি ফুলের গাছে নতুন ফুল ধরেছে। বেলি ফুল নিতির অনেক প্রিয়। তাই বারান্দায় টবে, এই ফ্ল্যাট কেনার পর পরই লাগিয়েছে বেলি ফুলের গাছ রূপক। ফুল ছিঁড়ে আনতে গিয়ে গাছ থেকে, উঁকি দিয়ে ছয় তলার এই ফ্ল্যাট থেকে গাড়িটা দেখল রূপক। রূপকের কপালে চিন্তার ভাঁজ। অস্থিরতা কাজ করছে ভিতরে। নিতি শুয়ে আছে বিছানায়। তাকিয়ে দেখছে রূপককে।


– এতো রাতে কী করছ বারান্দায়?

– আমাদের বেলি ফুলের গাছে ফুল এসেছে। তুমি কি খেয়াল করেছে?

বারান্দা থেকেই জবাব দিল রূপক।


– দেখেছি। এই রাতের বেলা তোমার বেলি ফুল দেখতে যাবার ইচ্ছা হল?

– না, বেলি ফুল তোমার পছন্দ। ভাবলাম একটা ফুল তোমাকে দেই।

– ফুল গাছেই সুন্দর লাগে। ছেঁড়ার দরকার নেই। তুমি আসো। ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব।


রূপক খানিক পরেই ফিরে এলো। বেলি ফুল হাতে নিয়ে। নিতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমার জন্য।

– ছিঁড়তে না করলাম।

– অনেক আগেই ছিঁড়ে ফেলেছি।


নিতি হাতে ফুলটা নিয়ে আলতো করে একটা হাসি দিল। রূপক পাশে শুয়ে যেতেই, বুকের উপর হাতটা রাখল। নিতির মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই ছেলেটা অকারণেই এতোটা ভালবাসে নিতিকে। কখনও রাগ করে না, উঁচু গলায় কথা বলে না, নিতি রাগ দেখালেও চুপচাপ শুনে। নিতিকে অনেক বেশীই বুঝে ছেলেটা। নিতির মাঝে মাঝেই কারণ ছাড়া মন খারাপ হয়ে যায়। সে সময়টায় কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। রূপক তবু এটা বলে, ওটা বলে। নিতি যদি বলে, ভাল লাগছে না কথা বলতে।

রূপক চুপ করে কিছুক্ষণ থেকে বলে, আচ্ছা কথা বলতে হবে না, আমি জড়িয়ে ধরে থাকি তোমাকে, কেমন?

পিছন থেকে চুপচাপ জড়িয়ে ধরে বসে থাকে রূপক। নিতির সে বাঁধন ছাড়াতে ইচ্ছা করে না। কীভাবে যেন মনটা একটু পরেই ভাল হয়ে যায়। রূপকের সাথে পরিচয়ের আট দিনের মাথায় বিয়ে। নিতি চাকরি করত যে অফিসে, সে অফিসেই এসে দায়িত্ব নেয় রূপক। কম্পানির বনানী শাখায় সব দায়িত্ব ছিল রূপকের। এরপর ধানমন্ডির প্রধান শাখার দায়িত্ব পড়ে রূপকের উপর। নিতির বেশ খোঁজ খবর নিত প্রথম থেকেই কেন যেন রূপক। অফিসের আরও অনেকে থাকার পরও নিতির প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ দিত। তিন দিনের দিন, অফিস শেষে নিতি যখন বের হয়। রাস্তা পাড় হবার সময়টায় পাশে এসে দাঁড়ায় রূপক। নিতি মুখ তুলে তাকাতেই রূপক ছোট একটা হাসি দিয়ে বলে, ভাল আছেন?

– জ্বি স্যার। আপনি ভাল আছেন?

– ভাল। বাসায় যাচ্ছেন?

– জ্বি।

– আপনার পড়াশুনা কী শেষ?

– জ্বি স্যার। এ বছরই অনার্স শেষ করলাম।

– আচ্ছা আচ্ছা। আসলে সরাসরি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, আপনি কী মনে করেন বুঝতে পারছি না।


নিতি একটু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রূপকের দিকে। রূপক নিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাচ্ছিলাম। সেটা অবশ্যই, যদি আপনার পছন্দের কেউ না থাকে। আর আমাকে যদি খুব বেশী অপছন্দ না হয়।

নিতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রূপকের দিকে কথাটা শুনে। রূপক তাকায় নি নিতির দিকে। এতো সাহস করে সোজা সাপ্টা বিয়ের কথা বলে দিয়েই বোধহয় লজ্জায় কুঁচকে গেছে রূপক। রূপকের সেই লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে কেন যেন সেদিন খুব ভাল লাগছিল।

বাসায় বিয়ের প্রস্তাব গেল। কম জানা একটা মানুষের সাথে হুট করেই বিয়ে হয়ে গেল নিতির। রূপককে জানত কম, বুঝত কম, এতো দ্রুত ভালবাসাও জন্মায়ই। তবুও কেন যেন একটা টান অনুভব করত রূপকের প্রতি। এই টানেই হয়ত খুব দ্রুত বিয়ের পর ভালবাসাটা তর তর করে বেড়েছে। কিংবা রূপক অল্প সময়েই অনেক বেশী ভালবাসাতে সম্পর্কটা এতো দ্রুত এতো স্বাভাবিক হয়েছিল। রূপক কেন এতো ভালবাসত জানে না নিতি। তবে কারণটা বেশ ভাল করেই জানা রূপকের। নিতি রূপকের প্রথম ভালবাসা না। ছয় বছর কম সময় নয়। ছয় বছরের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল লিয়ার সাথে। প্রথম দিকটায় এতোটা বোঝাপড়া ছিল সে সম্পর্কে ভুলেও মনে হয় নি, ভেঙে যাবে সম্পর্ক, কখনও হয় নি মনে আদৌ ভেঙে যাওয়া সম্ভব লিয়া আর রূপকের ভালবাসার সম্পর্কটা। ভার্সিটিতে পা দেবার পর পরিচয়, এরপর ভালবাসা। সে ভালবাসা বিরামহীন ভাবে এতোটা বছর চলে এসেছে। লিয়ার অনেক কিছুই খারাপ লাগত রূপকের। কিন্তু বলত না কখনও কিছু। শুধু মাঝে মাঝে বলত, লিয়া তুমি এভাবে চললে আমাদের সম্পর্কটা টিকবে না।

লিয়া রাগ দেখিয়ে বলত, সম্পর্ক টিকবে না মানে কী? তুমি আমার সাথে থাকতে চাচ্ছ না আর?

– আমি তেমন কিছুই বলছি না। তোমার কি মনে হয় না, তুমি যা করছ তা ঠিক না?

– কোন কাজটা তোমার বেঠিক লাগে?


রূপক ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বেঠিক লাগে অনেক কিছু, তবুও সঠিক ভেবেই মনকে বুঝায়, সব ঠিক আছে। আমি যে মানুষটাকে ভালবাসি এতো, সে মানুষটাও তেমন বাসে। লিয়ার ছেলে বন্ধুদের কখনই ভাল লাগত না রূপকের। বেশী বড়লোকের মেয়ে, বন্ধু বান্ধব এমনিতেই বেশী ছিল। সে বন্ধু গুলোকেই অসহ্য লাগত রূপকের। সপ্তাহে একদিন বরাদ্ধ থাকত লিয়ার সে বন্ধুদের জন্য। সে দিনটা রূপকের সাথে মোটামুটি যোগাযোগ বন্ধ। সে দিনটা বড় গুমোট একটা অস্বস্তিতে কাটত রূপকের। যদি কখনও মুখ ফসকে বলে দিত, তোমার এতো ছেলে বন্ধু আমার ভাল লাগে না লিয়া।

লিয়া স্বভাব সুলভ রাগ দেখিয়ে বলত, রূপক, তুমি এমন আচরণ করছ কেন? আমার বন্ধুদের মেনে নিয়েই তুমি আমার সাথে সম্পর্ক করেছ। এখন কেন খারাপ লাগছে? আর তুমিও যদি এমন কর আমার করার কিছু নেই।

রূপক মেনে নেয়, চুপ করেই মেনে নেয় সেসব কিছু। মন থেকেই চাইত লিয়ার সাথে সম্পর্কটা না ভেঙে যাক। এই বিষয় গুলো নিয়ে খারাপ লাগা আনতে চাইত না ভিতরে রূপক। বুঝত ব্যাপার গুলো বাচ্চা সুলভ কিছু। তবুও কেন যেন খারাপ লাগা চলে আসত। সম্পর্কের প্রথম দিকটায় লিয়ার কোন বন্ধুকেই বিরক্ত লাগত না রূপকের। কিন্তু শেষ দিকে এসে নাবিদ নামের ফটোগ্রাফার বন্ধুটার সাথে মেলামেশা কেন যেন মানতে পারত না। হুটহাট এখানে ওখানে চলে যেত ছবি তুলতে। নাবিদের ভাল একটা ক্যামেরা আছে, সে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবার জন্য, একজন নিয়মিত সুন্দরী মডেল দরকার। নাবিদের মডেল ছিল লিয়া। রোদ উঠলে ছবি তুলতে হবে, মেঘ করলে ছবি তুলতে হবে, বৃষ্টি নামলে তুলতে হবে ছবি, শিশিরে ঘাস ভিজে গেলে তুলতে হবে ছবি, জ্যোৎস্না থাকলে তুলতে হবে ছবি। একদমই সহ্য সীমার বাহিরে ছিল ব্যাপার গুলো রূপকের। তবুও মেনে নিত। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার তাগিদে।

কিন্তু সব কিছুই হুট করে ওলট পালট হয়ে যায়। নাবিদ কিছু ছবি পাঠায় ইনবক্সে রূপকের, পাঠিয়ে বলে, আশা করি এই ছবি গুলো আপনি দেখেন নি লিয়ার।

লিয়ার এ ধরণের ছবি নাবিদের কাছ থেকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রূপক। হঠাৎ করেই মাথাটা বড় ঝিম ধরে যায়, বড় কষ্ট লাগে বুকের বাম পাশটায়। ছয় বছরের চেনা জানা মানুষটাকে হঠাৎ করেই খুব অচেনা লাগে, খুব আপন মানুষটাকে খুব পর মনে হয়। এরপর আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। বিশ্বাস বড় অদ্ভুত একটা জিনিস, বিশ্বাস দুটি মানুষকে যেমন অদ্ভুত ভাবে আপন করে দিতে পারে, অবিশ্বাস তেমনি খুব বিশ্বাসের মানুষটাকেও হুট করেই অনেক বেশী পর করেও দিতে পারে। রূপক সে ছবি গুলো পাঠায় লিয়াকে, পাঠিয়ে ছোট করে একটা মেসেজ দেয়, আশা করি এরপর অন্তত তোমার আর আমার মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকা যায় না। সম্ভব না। আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না, ঠিক আছে?

লিয়ার সাথে সেই সম্পর্ক ভেঙে গেল, ছয় বছরের ভালবাসার সম্পর্ক। কষ্ট হচ্ছিল যদিও খুব রূপকের। তবুও চেষ্টা করত কাটিয়ে উঠবার। পারত না। বার বার ঘুরে ফিরে, লিয়ার ছবিটা ভেসে উঠত চোখে।

সে সময়টায় পরিচয় নিতির সাথে। নিতির মাঝে কেমন যেন লিয়ার একটা ছায়া পেত রূপক। প্রথমবার দেখে নিতিকে দেখে লিয়া ভেবে ভুল করেছিল রূপক। প্রথম দিন কথা বলতে বলতেই জানতে চেয়েছিল, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, কিছু মনে না করলে?

– জ্বি স্যার বলেন।

– আপনি কি লিয়া নামে কাউকে চিনেন? মানে আপনার বোন বা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে লিয়া নামে কেউ আছে?

– জ্বি না স্যার।

– আচ্ছা আচ্ছা।


তবুও নিতির মাঝে লিয়ার অদ্ভুত একটা অবয়ব পেত রূপক। লিয়ার মত হাসি, লিয়ার মত তাকানোর ধরণ, লিয়ার মত কথা বলার ভঙ্গিমা। লিয়ার যে ছবিটা চোখে লেগে আছে রূপকের, গেঁথে আছে মনে, তারই যেন প্রতিচ্ছবি দেখত প্রতিনিয়ত নিতির মাঝে রূপক। তাই কারণে অকারণে বার বার অফিসে এসে নিতির খোঁজ নিত, কথা বলত, সুবিধা অসুবিধা জানতে চাইত। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয়, লিয়ার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট নিতিই পারবে দূর করতে, দরকার বড় বেশী নিতিকে দরকার। লিয়ার প্রতিচ্ছবি ছিল বলেই হয়ত এতো দ্রুত এতোটা ভালবাসা এসে গিয়েছিল নিতির প্রতি। নিতির সাথে বিয়ের পর থেকেই কেন যেন নিজেকে বড় পরিপূর্ণ, বড় পরিপক্ক, বড় বাচ্চা সুলভ আচরণহীন মনে হয় নিজেকে। যে সন্দেহ গুলো দানা বাঁধত লিয়াকে ঘিরে, কখনও তার বিন্দু মাত্রও আসে নি নিতিকে নিয়ে। অবিশ্বাস জিনিসটা কেন যেন যায় না নিতির জন্য। বিয়ের বয়স ছয় মাস পেরিয়েছে, এর মধ্যে লিয়ার শূন্যতা একবারও অনুভব করে নি রূপক। নিতিকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে, বড় বেশী বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে রূপকের। নিতি কখনও যদি বলে, আমি বাহিরে যাব আজ একটু আসতে দেরী হবে। রূপক কখনও জানতে চায় না, কোথায় যাচ্ছ? অবিশ্বাস আসে না। এইতো পাঁচ দিন আগে রূপকের কাছে বলল, তুমি আমাকে কোনভাবে ৫০ হাজার টাকা যোগাড় করে দিতে পারবে?

এতো টাকার কথা শুনে একটু অবাক হলেও, রূপক জানতে চায় নি, কী করবে টাকা দিয়ে। ব্যাঙ্ক থেকে তুলে পরদিন নিতির হাতে তুলে দিয়েছিল রূপক। কিছু নিয়েই কখনও দুজনের মাঝে হয় নি, মনমালিন্য। শুধু একদিন নিতি বলেছিল, আচ্ছা তুমি আমার কাছে প্রথম দিন জানতে চেয়েছিলে, লিয়া নামে আমি কাউকে চিনি কিনা, কেন বলতো?

রূপক একবার ভেবেছিল মিথ্যে বলবে। কিন্তু ইচ্ছে করছিল না, মিথ্যে বলতে নিতির সাথে। পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, আচ্ছা বলব। কিন্তু রাগ করতে পারবে না, ঠিক আছে?

– আচ্ছা করব না।

– আমার লিয়া নামে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল।


কথাটা শুনে নিতি চুপ হয়ে গিয়েছিল। কেমন শূন্য দৃষ্টি নিয়ে রূপকের দিকে তাকিয়েছিল। রূপক বলতে থাকে, আসলে, মেয়েটা…।

নিতি মুখটা চেপে ধরে রূপকের।

“আর কিছু বলতে হবে না। আমার তোমার মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনতে ভাল লাগে না।”

– আমি তোমাকে ভালবাসি, নিতি।

– আমি জানি।

নিতি এরপর জানতেও চায় নি, লিয়ার ব্যাপারে কিছু কখনও। কীভাবে প্রেম হল, কীভাবে ভাঙল, সম্পর্ক এগিয়েছিল কতদূর। সেদিনটা একটু মনমরা থেকে, পরদিন থেকেই স্বাভাবিক ছিল নিতি।


পাশে ঘুমাচ্ছে নিতি। রূপকের বুকের উপর একটা হাত রেখে। রূপক আস্তে করে হাতটা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঘুমিয়ে থাকা নিতির গালে আলতো করে একটা চুমো দিয়ে, বারান্দায় গিয়ে আবার দাঁড়াল। গাড়িটা এখনও থেমে আছে বাড়িটার সামনে, ল্যাম্পপোস্টের নিচে। সাদা গাড়িটা হলুদ লাগছে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। বুকের ভিতর আবার চিন চিন করে একটা ব্যথা করছে। বিছানায় শুয়ে থাকা নিতির দিকে তাকাল রূপক। সত্যি নিতিকে বড় ভালবাসে রূপক। লিয়ার চেয়েও বেশী। অনেক বেশী।

লিয়া আবার ফিরে আসুক এ মিষ্টি ভালবাসার মাঝে একদম চায় না রূপক। একদমই না।

গত সপ্তাহে শুক্রবারটায় দুপুরের ভাত খাবার সময়, নিতি ভাত মুখে তুলতে তুলতে রূপককে বলল, আমাদের নিচ তলায় ফ্ল্যাটটাও বিক্রি হয়ে গেছে।

এটা বলার মত কোন কথা না, তবুও নিতি বলল। এই বাড়িটায় অনেক ফ্ল্যাট। কবে কোন ফ্ল্যাট বিক্রি হল, তা জানার কথা নিতির না। নিতি বলে যায়, আমাদের নিচ তলাটা নিয়েছে একটা মেয়ে। জানো এতো বড় ফ্ল্যাট, একাই থাকে। ওর বাবা নাকি ওকে এটা গিফট করেছে।

রূপক ভাত মুখে দিয়েই, তাকায় নিতির দিকে।

– তুমি জানো কী করে এসব?

– আরে মেয়েটা কাল এসেছিল, আমাদের বাসায়। আমার সাথে অনেক গল্প করল। দরজায় এসে নক করল, আমি তো প্রথমে দরজা খুলতেই চাই নি। ভাবলাম কে না কে। পরে বলল, নিচ তলার।

– আচ্ছা আচ্ছা।

– সবচেয়ে মজার বিষয় কি জানো?

– কী?

– মেয়েটার নাম লিয়া। এই লিয়া আবার তোমার লিয়া না তো? হিহি।


ভাত খাবার মাঝে থেমে গেল রূপক। কাশি দিল কয়েকটা। নিতি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও পানি খাও।

রূপক ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিল। রূপকের চোখে মুখে একটা অন্য রকম ভাব, আর নিতির মুখটা হাসি হাসি। রূপকও একটু স্বাভাবিক হতে বলল, আরে কী বল না তুমি। লিয়া নামে মেয়ে কী পৃথিবীতে একটাই? আর ভাল হল তো, তোমার সাথে মাঝে মাঝে এসে গল্প করবে মেয়েটা। আমি অফিসে থাকলে তো একাই থাকো বাসায়।

নিতি হেসে দেয়, হাসে রূপকও। রূপকের সে হাসিটা সত্যি ছিল না, জোর করে হাসা। মনের মধ্যে খচ খচ করে, কানের কাছে বার বার লিয়া নামটা বাজতে থাকে। যে আশঙ্কা করেছিল রূপক, যে কথাটা কথার ছলে বলেছিল নিতি। সে কথাটাই সত্যি। নিতি যেদিন লিয়ার কথা বলে তার পরদিন অফিস করে বাড়ি ফেরার পথে, পাঁচ তলার বারান্দার দিকে একবার তাকায়। লিয়াই ছিল সেটা। ভীষণ অস্বস্তি হয় লিয়াকে দেখে, দর দর করে ঘামে রূপকের কপাল। লিফট বেয়ে উঠবার সময় কাঁপা কাঁপা হাতে লিফটে ৫ এ চাপ দেয় রূপক। কেন দেয় জানে না। কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে লিয়ার। ফিরে আসতে যাবে তখনই দরজাটা খুলে যায়। লিয়া একটা স্মিত হাসি দিয়ে মাথাটা বের করে বলে, ভিতরে আসবে?

রূপক পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। পিছন ফিরে তাকায় না। শুধু অনুভব করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখনও লিয়া। তাকিয়ে দেখছে রূপককে। রূপক ফিরে যেতে চায় না অতীতে। বর্তমান নিয়েই টেনে নিয়ে যেতে চায় ভবিষ্যতে। তবুও এ কয়েকদিনে খুব দ্রুত অনেকবার সে অতীত এসে সামনে দাঁড়ায়। যে অতীত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছে ছয় মাস আগেই।

তার পরদিনও অফিসে যাবার পথে গাড়ি থেকে নামতেই লিয়া এসে হাজির। রূপকের সামনে এসে বলে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?

– আমার তোমার সাথে কোন কথা নেই।

– আমার সাথে তোমার ছয় বছরের সম্পর্ক ছিল। এখন কয়েক মিনিট তোমার কাছ থেকে পাওয়া আমার অধিকার।

– আমার জীবনে তোমার অধিকার বলতে কিছু নেই। প্লিজ, ঝামেলা বাধিও না কোন। আমি নিতিকে অনেক ভালবাসি। ওকে নিয়ে আমি ভাল থাকতে চাই।

– এই ভালবাসাটা তো আমাকেও বাসতে।


রূপক লিয়ার কোন কথা শুনে না। হন হন করে অফিসে ঢুকে যায়। রূপকের মাঝের অস্থিরতা টের পায় নিতি। বারবার জানতে চায়, তোমার কি শরীর খারাপ? কিছু নিয়ে চিন্তিত? অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে?

রূপক নিতির মুখের দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বলে, আমি ঠিক আছি নিতি।

পরদিনও বিকাল বেলা অফিস ফেরার পথে লিয়া এসে কথা বলে রূপকের সাথে।

– আমি তোমাকে মেসেজ দিয়ে বললাম, আমরা যেখানটায় দেখা করি সেখানে আসো। আসলে না কেন?

– তোমার সাথে দেখা করার নেই কিছু লিয়া। আর আমার মোবাইলে কোন মেসেজ আসে নি। তুমি তোমার মত থাকো, আমাকে আমার মত থাকতে দাও। নয়ত খারাপ হবে কিন্তু।


পাশ কাটিয়ে চলে যায় রূপক। বড় যন্ত্রণা হয় বুকের ভিতর। এই যন্ত্রণা ভাল লাগে না রূপকের। ভয় হয়, নিতিকে না এসে উলট পালট কিছু বলে। নিতি মেয়েটাকে নিয়ে ভাল থাকতে চায় রূপক।

গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে আসছে রূপকের। ঘুম পাচ্ছে। আর একবার গাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বিছানায় এসে শক্ত করে ঘুমিয়ে থাকা নিতিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল রূপক।

খুব ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল রূপকের। তখনও সূর্য উঠে নি। ঘুম ভাল হয় নি চিন্তায়। নিতিকে সরিয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়াল আবার। বেলি ফুল ফুটে আছে গাছটায়। বারান্দা থেকে নিচে তাকাল। এখনও ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। অতটা আলো হয় নি পথ ঘাট। সাদা গাড়িটা নেই ওখানে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রূপক। কিন্তু যে জায়গাটায় গাড়িটা ছিল, সে জায়গাটায় সাদা টি শার্ট পরা একটা মেয়ে পড়ে আছে। সাদা টি শার্টটা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হলুদ লাগছে। এই মেয়েটা রূপকের পরিচিত। বড় পরিচিত।

পিছন থেকে একটা নরম হাত রূপকের কাঁধের উপর স্পর্শ করল। চমকে ঘুরে তাকাল রূপক। নিতি দাঁড়িয়ে পিছনে।

– কী হয়েছে রূপক? এতো ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে গেলে।

রূপক মুখে কিছু না বলে, হাত দিয়ে নিচে রাস্তায় ইশারা করল। নিতি সেদিকে উঁকি দিয়ে বলল, কে যেন পড়ে আছে। তুমি আসো তো, ওসব ঝামেলায় যেতে হবে না।

রূপককে টেনে নিয়ে আসল বিছানায়।

– এতো দ্রুত উঠতে হবে না।

বলে রূপকের পাশে শুয়ে পড়ল নিতি। রূপকের মাথার ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছে, মেয়েটা ওভাবে পড়ে আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে?

নিতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপকের দিকে। রূপক যা ভাবছে তার উত্তর জানে নিতি। ভাল করেই জানে। ওখানে পড়ে আছে লিয়া। জীবিত লিয়া না, লিয়ার লাশ। ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে, জীবিত রাখার জন্য না। এই লিয়াকেই যে ভালবাসত রূপক তাও জানে নিতি। রূপক প্রতিটা দিন অফিস যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হবার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে নিতি। লিয়া এখানে আসার পর থেকে, প্রতিটা দিন রূপকের গাড়ির পিছন পিছন বের হতে দেখেছে লিয়ার গাড়ি। লিয়ার গাড়ি চিনে নিতি। একদিন অফিস শেষে বাসার সামনে কথাও বলতে দেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সেদিন মোবাইল রেখে যখন রূপক গোসলে গিয়েছিল, একটা মেসেজ আসে রূপকের মোবাইলে। নিতি মেসেজটা ওপেন করতেই দেখে, ” আমরা যে জায়গাটায় দেখা করতাম সবসময়, সেখানে আসবা আজ। তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। না আসলে, তুমি ভাবতেও পারবে না কি হবে? আমি কিন্তু প্রতিদিন তোমার বাসায় যাই। নিতির সাথে কথা বলি। -লিয়া।”

সাথে সাথেই মেসেজটা ডিলিট করে দেয় নিতি। দেখতে পায় না রূপক। জানেও না কিছু। জেনে যায় অনেক কিছু নিতি। রূপক বেরিয়ে আসতেই গোসল করে, নিতি তাকিয়ে থাকে রূপকের দিকে। দৌড়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে।

“তুমি আমার শুধু রূপক। আমি ভালবাসি তোমাকে।”

রূপক বুঝতে পারে না, কেন বলছে নিতি এসব। রূপকের দিকে তাকিয়ে মনে মনেই বলে নিতি, তোমার ভাগ আমি কাউকে দিব না। কাউকেই না। এক বিন্দু পরিমাণও না।

লিয়াকে খুন করবার জন্য টাকাটা নেয় রূপকের কাছ থেকে। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যোগাড় করে টাকার বিনিময়ে খুন করা খুনী। লিয়া প্রতি রাতে নাইট ক্লাব থেকে রাত করে বাড়ি ফিরে, সে সময়টায় থাকে না কেউ আশেপাশে। গাড়ি করে লোক অপেক্ষা করে বাড়িটার সামনেই। লিয়া গাড়ি নিয়ে আসতেই, আগেই পথে আগলে ধরে। সুন সান নীরবতায় খুন করে চলে যায়।

নিতির ভালবাসার সবটা নিতির করে দিয়ে যায়।

নিতি রূপকের বুকে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলে, ভালবাসি রূপক।

রূপক মৃদু স্বরে বলে, ভালবাসি নিতি।

– ভালবাসি কথাটার অর্থ জানো?

– কী?

– ভালবাসি যখন কাউকে বলছ মন থেকে, মানে সে বাসি হয়ে গেলেও তাকে তোমার ভাল লাগতে হবে। সারা জীবন ভাল লাগতে হবে। আমাকে তুমি ভালবাস। এই ভালবাসাটা সারাজীবন বাসতে হবে। আমি আমার ভালবাসার ভাগ কাউকে দিব না। এর জন্য আমি যা খুশী করব।


রূপক তাকিয়ে থাকে শান্ত দৃষ্টিতে নিতির দিকে। নিতির চোখে মুখে ভিন্ন রকম এক রক্তিম ভাব। এই দৃষ্টির সাথে পরিচিত নয় রূপক। তবে সে দৃষ্টি যত ভয়ংকরই হোক, সে দৃষ্টিতে আগলে রাখার, ধরে রাখা, ভালবাসা শুধু নিজের করে রাখার স্পৃহা আছে, খুব কাছে, খুব বেশী গভীরে, নিজের ভালবাসা লুকিয়ে রেখে দেবার বাসনা আছে।


সূর্য উঁকি দিচ্ছে আকাশে। তার আলো এসে পড়ছে সাদা বেলি ফুলের উপর। এসে পড়ছে সাদা টি শার্ট পরা মেয়েটার উপর। আর এদিকটায় সে আলো থেকেও দূরে অনেক দূরে শুধু নিজের করে রাখার চেষ্টায় ব্যাকুল নিতি রূপককে।

ভগ্নাংশের ভাগ বাদ দিয়ে পুরোটাই আমার, করার ভালবাসায় বিভোর দুটো হাত, দুটো চোখ, একটা অ ভগ্নাংশ মন। যার পুরোটাই শুধু একজনের।


গল্পঃ অভগ্নাংশ


লেখকঃআরাফাত ইসলাম।


কেমন হয়েছে বলবেন। 

রোমান্টিক সমগ্র ১


 অজান্তেই আলাপ


দিনটি ছিল বর্ষার। সেই সকাল থেকে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সকালে একটু পড়তে বসেও মনটা ঠিক লাগলো না। কি আর করা যায় ভালো না লাগলে একটি পথ যে আছে, ইন্টারনেট অন করে ফেসবুক করা ছাড়া আর কাজ কী? ফেসবুক অন করে দেখি একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কিন্তু এটা আবার কে চিনি না তো। আচ্ছা যেই হোক রিকোয়েস্টটা একসেপ্টই করি। কিছুক্ষণ পর মনে হলো একটু কথা বলে দেখিই না? মেসেঞ্জারে গিয়ে লিখলাম আপনি কে আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না, আপনি কি আমাকে চেনেন? দু'ঘণ্টা পর দেখি রিপ্লাই এসেছে যে সেও আমাকে চেনে না এবং সেও বুঝতে পারছে না কি ভাবে তার থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে হয়তো অজান্তেই হাত লেগে গিয়ে। এবং সেও তার ঠিক পরমুহুর্তে বলে আপনি কিছু মনে করবেন না ভুল করে এটি হয়ে গেছে। আমি বললাম ঠিক আছে এতে আবার ভুলের কি? এই বলে ফেসবুক অফ করে দিলাম। পুনরায় আবার যখন ফেসবুক অন করেছিলাম দেখতে পাই যে সে লিখেছিল আপনি চাইলে আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন।


কিন্তু কেন জানি না ওই অজান্তে আগত পাগলটা অর্থাৎ ওই অর্ঘ্যকে খুব স্পষ্ট কথায় আলাদা করতে আমার বেশি সময় লাগেনি। good sense of humour অর্ঘ্য আমার মনে একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল। ও তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এ থার্ড ইয়ার পড়ছে আর আমি সবে মাত্র ইলেভেনে পড়ি। বলতে গেলে আমার বড়ো দাদাই।


প্রথম প্রথম একটু আকটু কথা হতো কিন্তু তা থেকে থেকে দীর্ঘ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ও আবার মাঝে মাঝে আমাকে বলতো সবে ইলেভেনে পড়ো এখন থেকেই ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এসব করা শুরু করে দিয়েছো। আমি আবার তখন বলতাম তাহলে তুমি করো কেন? তখন আর কিছু বলতে পারত না। এইভাবে আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এর বিভিন্ন কথা চলতো। জানিনা কেন, এই ভাবেই আমার ওকে খুব ভালো লাগতে শুরু করে। ফেসবুক অন করে মনে হতো যে ও কখন অন আছে এবং অন না থাকলে মনে হতো কি এমন এত কাজ করছে। তারপর যখনই অন্ হতো আমি একটু রেগে যেতাম। ও তখন বলতো আমার জন্য তুমি রেগে যাচ্ছ কে হই আমি তোমার? তখন আমার মন খারাপ হয়ে যেত, আর সেটা ও যেন কিভাবে বুঝতেও পেরে যেত আর আমাকে বলত আচ্ছা বাবু সরি সরি আর কখন ও হবে না এই আমার কান ধরলাম।


এইভাবে সুখ দুঃখের মাঝে রাস্তা করে নিয়ে আমাদের দিন অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু আমি কখনও ওকে বলতে পারিনি যে আমি ওকে সত্যি খুব আপন করে ফেলেছি যেন নিজের থেকেও বেশি। কেন জানিনা ও যেন বড় দাদার মতো দাদাই হয়ে থাকতো। এইভাবে দিন এগোচ্ছিল -


প্রায় তিন বছর পর.....


আমি তখন বাংলাতে অনার্স নিয়েছি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি আর ও কি একটা চাকরি পেয়েছে। এবার যেন ওর কথাগুলো একটু গম্ভীর গম্ভীর বড্ড ব্যস্ত যেন কিছু জিজ্ঞাসা করলে যেন ঠিক করে বলেও না আর। বুঝতে পারি বড্ড কাজের চাপ তাই। আর আমি তো সেই যেমন ছিলাম তেমনই, কি আর বলবো। মাঝে মাঝে রাগ হতো মেসেজ সিন করেও রিপ্লাই দিত না, মনে হতো কোনো মিটিংয়ে আছে হয়তো। আমি আর কিছু বলতাম না। এইভাবে যেন বলেও না বলার মত চলছিল।


মাঝে মাঝে মনে হতো এবার বলেই দি ধুর আর ভালো লাগেনা। না থাক কি ভাববে ও! এই করে করে আর বলাও হয়ে ওঠেনি। এইভাবে কাটছিল।


দিনটি ছিল বুধবার যততা সম্ভব মনে পরে সেদিন বনধ ছিল তাই অন্যান্য ছুটির দিনগুলির মত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। ওই নটার দিকে উঠে মেসেঞ্জারটা খুলে দেখি দুটো ম্যাসেজ কার না, অর্ঘ্যর, ও আবার মেসেজ করেছে হ্যাঁ ঠিক, তাইতো।


আচ্ছা বোন 10 তারিখ আমার বিয়ে হঠাৎ করে ঠিক হয়ে গেল, আর বাবারও বয়স হয়েছে তাই তুমি ওইদিন অবশ্যই এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকলাম কিন্তু! আর বিয়ের কার্ডটাও পাঠিয়ে দিয়েছি।


কথাগুলো শুনে আমি যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেলাম, নিজেকেও জানো কেমন অজানা অজানা মনে হল সত্যিই কি আমি সেই মেয়ে, যে ওকে প্রানের চেয়েও বেশী ভালোবাসতো।


আমার কেন এমন মনে হচ্ছে আমি কে হই ওর, আমি তো কেউ না ওর, তাহলে আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে। সত্যি আমি কেউ না সত্যিই না, না। মনে মনে নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল মনে হচ্ছিল সমস্ত মেসেজ ডিলিট করে দি। মনে হচ্ছিল কেন এতদিন আমি এত সময় নষ্ট করলাম পড়া আছে না, আমি তো ছেলেদেরও বাংলা পড়াই, তাদের পড়াতে হবে না। যেন নিজেই নিজের চোখের জলকে প্রবাহের পথ দেখিয়েছি তাই হয়তো সে প্রবাহিত হচ্ছে।


অর্ঘ্য আবার বলল তুমি আসবেনা, আমি তাহলে কিন্তু খুব কষ্ট পাব, আমি তখন অশ্রুপাতে নিমজ্জিত অবস্থায় যার এক ফোটা অশ্রু হয়তো ওর শব্দ স্পর্শ করেছিল। আর আমি যেন অজান্তেই বলে ফেলি আচ্ছা দাদা যাব চিন্তা করো না। অর্ঘ্য বলে এইতো আমার প্রিয় বোন। জানি আমার সম্পর্কটি বোনেই সীমাবদ্ধ।


আর কেন জানিনা নিজে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম সবাই সবার জন্য হয়না, হয়তো তিনিই যা করেছেন ঠিকই করেছেন।


 সমাপ্ত


লেখকঃআরাফাত হোসেন।

ভৌতিক সমগ্র ৪


অশরীরী

লেখকঃArafat Islam

“স্যার এই নিন চাবি” সুব্রত চাবির গোছা এগিয়ে দিলো। চাবি নিয়ে রাজশেখর বললেন “তুমি ছাড়া এই বাড়িতে আর কে কে আছে কাজ করা দেখাশোনা করার জন্য?”

“আমিই আপাতত কেয়ারটেকারের ভূমিকা পালন করছি। চম্পা আর গৌর এই বাড়ি ঝেড়ে পুঁছে গুছিয়ে রাখে। যারা পিকনিকের জন্য আসে চম্পা তাদের রান্নাবান্নাও করে দেয়। তবে রাতে কেউ থাকে না তো আমরাও কেউ রাতে থাকি না। সন্ধ্যের মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে যাই। আমাদের বাড়ি অবশ্য খুব দূরে নয়। এই বাড়ির বাউন্ডারির ঠিক বাইরেই কিছু ঘর আছে সেখানেই থাকি। আসলে বাড়ির যিনি প্রথম মালিক ছিলেন তিনি এই ব্যবস্থাই করেছিলেন”

“ঠিক আছে। তোমাকে ডাকলে যাতে পাওয়া যায় তার কি কোন ব্যবস্থা আছে?”

“হ্যাঁ আছে স্যার। যে ঘরে আপনারা শোবেন সেই ঘরে একটা দড়ি ঝুলতে দেখবেন। সেটা টানলে আমার ঘরের ঘণ্টাটা বেজে উঠবে, আমি জানতে পারবো আপনারা ডাকছেন”

“তুমি তো আমাকে সেই আদ্যিকালের গল্প শোনাচ্ছ। তোমার মোবাইল নেই যাতে ফোন করলে তুমি জানতে পারবে?”

“হ্যাঁ আছে স্যার। তবে বুঝতেই তো পারছেন গ্রামাঞ্চল তো সন্ধ্যার পর ভালোভাবে টাওয়ার কানেকশন পাওয়া যায় না”

“ওঃ ঠিক আছে। তা তুমি কি এখনি চলে যাবে?”

“তা কেন স্যার। আপনারা রাতে কি খাবেন সেটা বলে দিলে চম্পাকে দিয়ে বানিয়ে ঘণ্টাখানেক পরে এসে পৌঁছে দিয়ে যাবো”

রাজ ওর বন্ধু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন “কি হে রাতে কি খাবে? এরকম ব্যাপার জানলে খাবার কিনেই নিয়ে আসতাম আসার পথে”

অনি বললেন “আরে অত চিন্তা কীসের। ও তো বলছে রান্না করিয়ে দিয়ে যাবে”

“তাহলে বলো কি খাবে?”

“বেশি আর কি লুচি আর পাঁঠার কষা মাংস, আর একটু গা গরম করার পানীয়” তারপর সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল “কি হে হবে তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিই নিয়ে আসবো”

“ঠিক আছে তাহলে এসো। আমরা একটু ঘুরে দেখি বাড়িটা কেমন। আর যে ঘরে শোব তা কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছো তোমরা”

সুব্রত চলে যাওয়ার পর রাজ আর অনি নীচের ড্রয়িংরুম থেকে পায়ে পায়ে উঠে আসে দোতলায়। পুরনোদিনের জমিদারদের বাড়ি গঙ্গার পাড়ে। এক কালে নাকি জমিদাররা এখানে থাকতো তারপর কোন এক পুরুষ শহরের দিকে বাড়ি করে ওখানে সপরিবারে চলে যান। তারপর থেকে বাড়িটা পড়ে ছিল। কয়েক পুরুষ পর এক ছেলে যে বর্তমানে বাড়ির মালিক বাড়িটা ভাড়া দিচ্ছেন পিকনিক করার জন্য। এতো বড় বাড়ি দেখাশোনা করে রাখার খরচ প্রচুর। বাড়ি ভাড়া দিলে কিছু টাকা তো উঠে আসে। তাই এই ব্যবস্থা।

বাড়ির ভেতরে পা দেওয়ার পর ওদের দুজনেরই মনে হচ্ছিলো যেন সত্যি জমিদার আমলে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ওদের ঘরে এসে উপস্থিত হলেন ওরা দুজনে। বেশ উঁচু রাজকীয় খাটে শুভ্র সফেন বিছানা পাতা। তার সাথে বালিশ কোলবালিশ, সব আছে। ঝাড়বাতিটা জ্বলছে, এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পাখার সুইচ দিতে পাখা বেশ জোরে ঘুরতে শুরু করলো। ওরা ঘরের লাগোয়া বাথরুমে এক এক করে ফ্রেশ হয়ে এলেন। রাজ দোতলার লাগোয়া বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর হাত দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুললেন। কিন্তু দরজা খুলল না। বেশ চাপ দিতে হল ওটাকে ঠেলে খুলতে। অবশ্য দরজা খুলে যেতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এলো ঘরে। ততক্ষণে বাথরুম থেকে অনিও বেরিয়ে এসেছেন। বললেন “রাজ তোমার জন্য একদিনের জন্য নিজেকে জমিদার বাড়ির সদস্য মনে হচ্ছে”

রাজ হাসলেন “তবেই বল, তুমি তো ভাই আসতেই চাইছিলে না”

“তখন কি আর বুঝেছি এতো সুখ কপালে নাচছে”

হঠাৎ দরজায় এসে উপস্থিত হল সুব্রত। বলল “স্যার আপনাদের খাবার নিয়ে এসেছি। নীচে ডাইনিঙে খাবেন না এখানে দিয়ে যাবো”

“নীচেই চলো, বিছানায় বসে কি আর খাওয়া যায়?”

“চলুন” বলেই সুব্রতর চোখে পড়লো বারান্দার দিকে খোলা দরজার ওপরে, বলল “এটা কে খুলল?”

রাজ উত্তর দিলেন “আমি। ঘরের গরম হাওয়াটা বেরিয়ে যাবে”

সুব্রত আর কোন কথা ও বিষয়ে না তুলে বলল “তাহলে আসুন নীচে। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি”

নীচে ডাইনিঙে এসে ওদের চক্ষু ছানাবড়া। যা বিশাল এক ডাইনিং টেবিল পাতা মনে হয় একসাথে জনা তিরিশ লোক বসে খেতে পারবেন। তবে অত লোক এখন না খেলেও টেবিল কিন্তু আগের আমলের মতোই সাজানো। ওরা দুজন এসে মুখোমুখি বসতেই সুব্রত খুব সুন্দর করে সব সাজিয়ে দিলো। তারপর বসে বসে খাওয়া তদারকিও করলো। খাওয়া শেষ করে উঠতে ও বলল “আপনারা হাত ধুয়ে বসার ঘরে আসুন আপনাদের পানীয় ঢেলে দিচ্ছি”

দুজনে এসে বসতে সুব্রত পরিমাণ মতো সব মিলিয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলো দুজনের দিকে। রাজ বললেন “অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। অনেক করেছ আমাদের জন্য। আর থাকতে হবে না। রাত তো অনেক হল এবার তুমি এসো। দরকার পড়লে তোমাকে পাবো তো?”

“হ্যাঁ স্যার পাবেন। আমি আসি তাহলে। শুভরাত্রি” সুব্রত চলে গেলো। ওরা একটু করে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন আর গল্প করছেন। হঠাৎ অনি বললেন “বুঝলে রাজ সব ব্যবস্থা যখন করলে তখন জমিদারের নাচঘরের বাইজির ব্যবস্থাও করতে আরও আনন্দ পেতাম। কোনদিন তো সামনে থেকে ওসব দেখার সুযোগ ঘটলো না”

“হুম এটা বেড়ে বলেছ কিন্তু আগে বললে হত এখন আর কি হবে”

“সুব্রতকে বললেই হত”

“ও কি এতো তাড়াতাড়ি এর ব্যবস্থা করতে পারতো, মনে হয় না”

“আহা ওই চম্পা না কে ও’ই আসতে পারতো আমাদের মনোরঞ্জন করতে”

এই গল্পের মাঝেই হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলো। রাজ বললেন “যাহ্‌ লোডশেডিং! সুব্রত তো আগে বলেনি যে আলোও হঠাৎ হঠাৎ যেতে পারে। নাহলে ওকে দিয়ে দু তিনটে মোম আনিয়ে রাখতাম”

“হুম! এরকম বাড়িতে আলো চলে গেলে কেমন যেন অনুভূতি হয়”

“কি হে তোমার ভয় করছে নাকি?”

“ঠিক ভয় নয়”

“তুমি সেই আগের মতোই ভীতু রয়ে গেছ জানতাম না” কথার মাঝে কীসের যেন শব্দ হল ঘরের মধ্যে। অনিমেষ জিজ্ঞেস করলো “কীসের শব্দ ওটা?”

“কোথায় শব্দ?”

“তুমি শুনতে পাচ্ছ না? কিন্তু আমি যে পাচ্ছি ঘুঙুরের শব্দ”

“কোথায়?”

“ওই শোন” এবার রাজও শুনতে পেলেন। অন্ধকারের মধ্যে দুজনেই এদিকওদিক তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন শব্দের উৎস কোথায়। খানিক অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্ধকার যখন চোখে ষয়ে এলো তখন দুজনেই দেখতে পেলেন এক সাদা পোশাক পরা মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নীচে আসছে। আর ওর নামার তালে তালে নুপুরের আওয়াজ উঠছে। দুজনেই চমকে উঠলেন। সুব্রত তো বলেছিল এ বাড়িতে কেউ থাকে না তাহলে এই মহিলা এলো কোথা থেকে। মহিলা এগিয়ে এলো কাছে। রাজ ভয়কে পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কে আপনি?” কিন্তু প্রশ্ন করতে করতেই টের পেলো ওর নিজেরই আওয়াজ অত চেষ্টার পরেও কেঁপে উঠলো। মহিলার হাসি শোনা গেলো। “সে কি তোমরা নর্তকীকে আহ্বান করলে আর এখন চিনতে পারছো না?”

“তোমাকে কে ডাকলো, আমরা তো ডাকিনি”

“ডেকেছ তো। তা কি নাচ দেখবে, কত্থক নাকি আধুনিক কিছু”

“তুমি যাও তোমায় আমরা ডাকিনি”

“এখন ডাকোনি কিন্তু তখন তো ডেকেছিলে আর আমি আমার শিশু সন্তানকে ছেড়ে আসতে চাইনি বলে জোর করে ধরে এনেছিলে। আর যাতে ভবিষ্যতেও একই সন্তানের দোহাই না দিতে পারি তাই ওকে মেরেই দিলে”

“কি সব বলছ আজগুবি, আমরা তোমাকে চিনিই না”

“চেনো চেনো। তোমাদের রক্তে আছে নারীদের নিয়ে ফুর্তি করা বদমায়েশি করা আর তোমাদের কথামতো না চললে তাদের পৃথিবী থেকেই হাপিস করে দেওয়া। সেই দুষিত রক্ত এখনো শরীরে বয়েই চলেছে তাই তো এতদিন পরেও এ বাড়িতে এসেই নর্তকীর কথা মনে পড়লো। সেবার ক্ষমতার অভাবে প্রতিশোধ নিতে পারিনি। এবার তো ছাড়া যায় না” বলেই দুটো হাত এগিয়ে গেলো দুজনের গলা লক্ষ্য করে। এতটাই আকস্মিক আর এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো সব কিছু যে ওরা পালানোরও সুযোগ পেলো না। সুব্রত সুব্রত করে আওয়াজ তুলতে চেষ্টা করেছিলেন রাজ কিন্তু গলায় স্বর ফুটলো না।

ওদিকে আঙ্গুলের চাপ বেড়ে চলল গলার ওপর। দুহাতে ধরেও ছাড়ানো গেলো না। অনি আর রাজ দুজনের কথাই আটকে গেলো। দুজনেই গোঁ গোঁ করতে লাগলো, কিন্তু গলার ওপর চেপে বসা হাত দুটোকে ছাড়াতে পারলো না। খানিক পরে দুজনেই গড়িয়ে পড়লো মাটিতে।

কিছুদিন পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করলো পচে গলে যাওয়া দুটি দেহ। অফিসার শুধু ভাবলেন এরা এখানে এলেন কি ভাবে।

কেমন হয়েছে বলবেন। 

ভৌতিক সমগ্র 3


 ভৌতিক গল্প 


বজ্রপাত


লেখকঃআরাফাত হোসেন


মাস্টারমশাই মাস্টারমশাই....


ছুটতে ছুটতে এসে এইটুকু বলেই হাঁফাতে থাকে ইসমাইল।


সবাই বলে স্কুল মাস্টারী সবথেকে সুখের চাকরি। সে যে কত সুখের চাকরি, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন হলধরবাবু। ইউনিট টেষ্ট, মিডডে মিল, তারপরে এটা আবার বোর্ডিং স্কুল; সবসময়েই কাজের চাপ। সামনের সপ্তাহে ছেলের বিয়ে তাও ছুটি পাননি। ফোনেই গিন্নির সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে নিচ্ছিলেন। কথার মাঝে ইসমাইল এসে পড়ায় বাধ্য হয়ে কথা থামাতে হল।


হেডস্যার যে যথেষ্ট রাগী সে কথা সব ছাত্ররাই জানে। হলধরবাবু তাঁর রাগী গম্ভীর গলাতে ইসমাইলকে শুধান,


-কি হলো, মাঠে বাঘ বেরিয়েছে নাকি! এমন ছুটতে ছুটতে আসার কি হলো?


তখনও হাঁফাচ্ছে ইসমাইল। দুটো ঢোক গিলে মুখ কাঁচুমাচু করে বলে,


-নতুন ছেলেটা....


এইটুকু বলেই থেমে যায় ইসমাইল।


-নতুন ছেলেটা কি করেছে? 


এক ধমক লাগান হলধরবাবু।


এবার আঙুল তুলে পুরনো হোস্টেলবাড়িটার দিকে আঙুল তোলে ইসমাইল। বলে,


-ওখানে ঢুকেছে ছেলেটা।


আঁতকে ওঠেন হলধরবাবু।


-তোরা ছেলেটাকে বলিসনি, ওখানে কারও ঢোকা বারণ আছে।


-আমরা কেমন করে জানব মাস্টামশাই যে ও ওখানে ঢুকবে। আমরা সবাই মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। হঠাৎ দীনেশ খেয়াল করে ছেলেটা দোতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই ওকে ওখান থেকে চলে আসতে বললাম কিন্তু ও ভেতরে ঢুকে গেল। এখনও বেরিয়ে আসেনি!


হলধরবাবু আজ প্রায় উনিশ বছর আছেন এই স্কুলে। তখন ঐ বিল্ডিংটাই ছাত্রদের হোস্টেল ছিল। সেবার এক কালবৈশাখী ঝড়ের রাতে বাজ পড়ে হোস্টেলের একটা অংশ পুরো ভেঙে পড়ে। কয়েকজন ছাত্র মারাত্মক রকমের আহত হয়েছিল। মারা গিয়েছিল একজন ছাত্র। মুখটুকু বাদে শরীরের একটা অংশ বিশ্রীভাবে ঝলসে গিয়েছিল।


আজ বারো বছরের বেশি হয়ে গেল, এখনও সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে শিউড়ে ওঠেন হলধরবাবু।


তারপর বছর খানেক ঐ বিল্ডিং অমন অবস্থাতেই পড়ে না। হোস্টেলের ছেলেদের স্টাফ কোয়াটার্সে সরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর থেকে যতবার ঐ বিল্ডিং সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে, একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। দোতলা অবধি তো কেউ পৌঁছাতেই পারেনি। শেষ অবধি ভূতুড়ে বিল্ডিং নাম নিয়ে বিল্ডিংটা ভাঙাচোরা অবস্থাতেই পড়ে আছে। 


ঐ নতুন ছেলেটা তো সদ্য কদিন হলো ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছে। ওর বাবা-মা দুজনেই কিভাবে যেন মারা গেছে। জ্যাঠা এসে ভর্তি করে দিয়ে গেছেন। উনি বলেছিলেন অবশ্য, ছেলেটি বড়ো দুরন্ত। কিন্তু এই ক'দিনে তো ছেলেটিকে বেশ চুপচাপই মনে হচ্ছিল। আর ভেবে কি হবে! এখন ভালোয় ভালোয় ঐ ছেলেকে ভূতুড়ে বিল্ডিং থেকে বের করে আনতে পারলে হয়। নাহলে কি কৈফিয়ত দেবেন ওর বাড়ির লোকের কাছে! শুধু কি বাড়ির লোক! পান থেকে চুন খসলেই পার্টি থেকে মিডিয়া, কেউ ঝাঁপিয়ে পড়তে বাকি থাকবে না।


স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন বিকালেই তো ছেলেরা ঐ মাঠে খেলা করে। ঐ ছেলের এই সন্ধের মুখে ঐ ভাঙা বিল্ডিংএ ঢোকার কি দরকার পড়ল কে জানে! আজকালকার ছেলেপিলেগুলোই বড্ড বেয়ারা। আর দেরি না করে ইসমাইলের সাথেই ঐদিকে পা বাড়ায় হলধরবাবু। 


অন্য ছেলেরা সব মুখ কাঁচুমাচু করে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হলধরবাবু বিল্ডিংএর দিকে এগোতে গিয়েও থমকে যান। গতবার এক মিস্ত্রি জোর করে ঢুকেছিল বিল্ডিংএ, ঘরের জিনিসপত্তর বের করে আনবে বলে। কিন্তু কি হলো, সবার চোখের সামনে সুস্থ মানুষটা মুখে রক্ত উঠে মরে গিয়েছিল। ডাক্তার ডাকার সময়টুকু অবধি পাওয়া যায়নি। 


খানিক পিছিয়ে আসেন হলধরবাবু। 


-যা তো, স্টাফ কোয়াটার্স থেকে স্যারদের ডেকে নিয়ে আয়।


হলধরবাবু ছাড়াও আর দুজন স্যার থাকেন এখানে। একা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার থেকে সবাই মিলে ভেবে কাজটা করাই ভালো। হলধরবাবুর মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতে দুজন ছেলে ছুট লাগায়। হলধরবাবু হাঁক পাড়েন,


-রামদীনকেও ডেকে আনবি।


স্কুলের দারোয়ান কাম নাইট গার্ড রামদীন। পেটানো চেহারা, ভয়ডরও খুব একটা নেই। এমন সমস্যায় তো রামদীনের মতো মানুষকেই সাথে দরকার।


ছেলেটা ভিতরে কি করছে কে জানে! সাড়াশব্দও তো নেই। মরে ফরে গেল না তো!


-না স্যার মরিনি, এই তো আমি।


চমকে ওঠেন হলধরবাবু। আরে ভূতের মতো দুম করে এ ছেলে উদয় হলো কোথা থেকে? এখনি তো সামনে কেউ ছিলনা। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দিয়েই জিজ্ঞাসা করেন,


-এই বিল্ডিংএ কেন ঢুকেছিলে! তুমি জানো না এখানে ঢোকা বারণ?


-কেন স্যার কি হয়েছে এই বিল্ডিংএ?


ছেলেটার কথায় কি ছিল কে জানে, কোন প্রতিবাদ করতে পারেন না হলধরবাবু। তার বদলে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা ব্যাখ্যা করতে লাগেন। 


-ছেলেটা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল স্যার?


বারো বছর আগের সেই ঝলসানো মৃতদেহটা আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলধরবাবুর। এতো বছর পরেও যেন ভয়ে শিউড়ে ওঠেন উনি। 


সামনে দাঁড়ানো নতুন ছেলেটাকে হাসতে দেখে মাথায় আগুন জ্বলে যায় হলধরবাবুর। বাজখাঁই গলাতে জিজ্ঞাসা করেন,


-হাসির কি হলো?


ছেলেটা তার পুলওভারটা খুলে ফেলে। দেখুন তো স্যার, এর থেকেও বেশি পুড়েছিল?


চমকে ওঠেন হলধরবাবু। কি বীভৎসভাবে পোড়া শরীরের বামদিকটা। এতো সেই বারো বছর আগের বাজ পড়ে ঝলসে যাওয়া ছেলেটাকে দেখছে মনে হচ্ছে। আকাশে মেঘ তো ছিল না, তবু খুব জোরে বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন। কাছাকাছি কোথাও বোধহয় বাজ পড়ল।


ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে হলধরবাবুর। উনি পিছন দিকে জোরে ছুটতে লাগেন। ঐ তো বঙ্কিমবাবু আর দয়ালবাবু আসছেন।


দয়ালবাবুই জিজ্ঞাসা করেন,


-ছেলেরা কি বললো, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। কে ঢুকেছে ঐ ভূতুড়ে বিল্ডিং এ?


বঙ্কিমবাবু বলছেন,


-ওরা বলছে নতুন ছেলেটা নাকি ঐ ভূতুড়ে বিল্ডিংএ ঢুকেছে। কিন্তু ওর জ্যাঠা আমার মোবাইলে ফোন করেছিলেন, ওর ঠাকুমা অসুস্থ তাই ওকে নিতে আসবেন আগামীকাল। ছেলেটাকে আমার ঘরে ডেকে পাঠিয়ে সেই কথাটাই বলছিলাম। ওতো আমার ঘরেই ছিল।


আপনি নিজে দেখেছেন? এই ছেলেদের কথার কোন ঠিক আছে নাকি কি দেখতে কি দেখেছে।


-আকাশে এমন মেঘ করেছে এখনও খেলা! খেললেই হবে, পড়তে বসতে হবে না! এখনি যে যার ঘরে গিয়ে ইংরাজী বই নিয়ে বসো। আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি।


দয়ালবাবুর বকুনিতে ছেলেরা সবাই হৈহৈ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে হোস্টেলের দিকে।


ছেলেরা কি দেখতে কি দেখেছে হতে পারে। কিন্তু হলধরবাবু একটু আগে নিজে যা দেখেছেন, তা ভুলবেন কি করে! কিন্তু সেকথা বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কাউকে কিছু না বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান হলধরবাবু। মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, ছুটি না পেলেও কাল সকালেই মেডিকেল লিভ নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।


আর মাত্র তিনবছর চাকরি আছে। গিন্নীর কথা মতো, এবার বাড়ির কাছাকাছি ট্রান্সফার নেওয়ার চেষ্টাটা করতেই হবে।


কেমন হয়েছে বলবেন

❤️❤️❤️

ভৌতিক সমগ্র 2


 দুপুরবেলা বউ আর সাত বছরের মেয়ে তাহেরাকে নিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন রমিজ মিয়া। ঠিক তখনই খবর আসে রমিজ

মিয়ার চাচা শ্বশুর মারা গেছেন। রমিজ মিয়া খবর শুনে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।


রমিজের শ্বশুরবাড়ি ছিল তার বাড়ি থেকে পাঁচ কি ছয় কিলোমিটার দূরে । তাই তিনি বউ আর মেয়েকে একটা ভ্যান গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলেন।গ্রামের কাঁচা রাস্তা তার উপর বর্ষাকাল হওয়ায় রাস্তায় অনেক কাঁদা জমে ছিল।

প্রায় এক ঘন্টা পর গিয়ে শ্বশুর বাড়ি পৌঁছায় রমিজ মিয়া। গোসল তারপর জানাযা শেষে আসরের নামাজের পর লাশ কে কবর দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাহেরা ওর বাবা রমিজের কাছে বায়না ধরে যে,

সেও কবর দিতে যাবে।


মেয়ের কথায় না করে দিয়ে রমিজ বলেন,

— তুমি ছোট মেয়ে মানুষ, সেখানে গিয়ে কি করবে?

তবে মেয়েটা তার বড্ড জেদি সে যাবে তো যাবেই।

অনেক কান্নাকাটি করার পর রমিজ মিয়া তাহেরাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়।

তবে তিনি বলেন যে, সে যেন সব সময় তার মামার সাথেই থাকে। তাহেরা রাজি হয়।

গ্রামের শেষ প্রান্তে চাষের জমির ভিতর গোরস্থান।


গোরস্তানটির চারদিকে কোন দেয়াল নেই, নেই কোন সীমানাও।

গোরস্থানে এসে রমিজ মিয়া তাহেরাকে ওর মামার কাছে রেখে বলেন,

— এখানে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকবা কোথাও যাবেনা।

তারপর রমিজ মিয়া লাশটিকে মাটি দিতে কবরের কাছে চলে যান।

কেমন করে লাশকে মাটি দেয় তা দেখার জন্য ভীষণ কৌতুহলী হয়ে যায় তাহেরা। তাই মামাকে কিছু না বলেই মাটি দেয়া দেখবে বলে ওপর পাশ দিয়ে কবরের পাশে গিয়ে যেই না উঁকি দেবে ঠিক তখনই একটা পুরোনো কবর ভেঙে ভিতরে পরে যায় তাহেরা।

তারপর চিৎকার শুরু করে দেয়। রমিজ মিয়া তাড়াতাড়ি মেয়েকে ভাঙা কবর থেকে তুলে বাসায় চলে যান। তারপর মেয়েকে আচ্ছা মত গালি দেন যে,

কেন সে তার কথা শুনলোনা ?

তাহেরার গায়ে যে কাঁদামাটি লেগে ছিল তা ধুয়ে দেন তাহেরার মা।


রাত প্রায় আট টা বাজে। খাওয়ার পর রমিজ মিয়া তার বউকে বলেন,

— আমি তাহলে এখন বাড়ি যাই কারণ গরু-ছাগল আছে আর তুমি মেয়েকে নিয়ে থাকো। কাল সকাল হলে চলে যেও।

রমিজের বউ তাকে চলে যেতে বলেন।

ঠিক তখনই তাহেরা ওর বাবার সাথে বাসায় যাবে বলে বাধ সাধে।

সবাই বলে,

–তুমি মায়ের সাথে থাকো, কাল সকালে যেও।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? সে যাবে তো যাবেই।


অবশেষে রমিজ মিয়া মেয়েকে সাইকেলের পিছনে নিয়ে রওনা হন।

বৃষ্টির পানি জমে থাকায় রাস্তাটিতে কাঁদা ভরা। রমিজ মিয়া আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

প্রায় এক কিলোমিটার আসার পর সামনেই একটা বড় মেহগনি গাছের বাগান পরে।আর এর পাশ দিয়েই রাস্তাটা চলে গেছে।মেহগনি গাছের বাগানের কাছে আসতেই হঠাৎ সাইকেলের চেইনটা পরে যায়।

রমিজ মিয়া সাইকেল থেকে নেমে চেইনটি তোলার সময় লক্ষ্ করেন তার পাশ দিয়ে কালো একটা বিড়াল চলে গেল। রমিজ মিয়া বিষয়টা আমলে না নিয়ে আবার সাইকেল চালাতে লাগলেন।


মেহগনি গাছের বাগানটার মাঝে আসতেই আবার সাইকেলের চেইন পরে যায়। রমিজ মিয়া আবার সাইকেল থেকে নেমে চেইনটা তোলার সময় লক্ষ্য করেন সেই কালো বিড়ালটা আবারো তার পাশ দিয়ে চলে গেল।

এবার একটু ঘাবড়ে যান রমিজ মিয়া।

তিনি বুঝে যান যে, এটা স্বাভাবিক কিছু না।


চেইনটা ঠিক করে সাইকেলে উঠবে ঠিক তখনই আবারও লক্ষ্য করেন প্রচণ্ড জোরে হাওয়া বইছে মেহগনি গাছের বাগানে। যেন সামনে এগুতেই পারছেন না। মেয়েকে একহাতে ধরে কোন রকমে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে বাগানটার শেষ প্রান্তে আসতেই একটা মেহগনি গাছের ডালের উপর চোখ পরে তার।

তিনি দেখেন, সাদা কাফন পরা একটা মানুষের অবয়ব সেখানে বসে আছে। তবে অবয়বটার মাথা নেই।

ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসে তার। তিনি ভাবেন,

— মেয়ে যদি এটা দেখে তো প্রচন্ড রকমের ভয় পাবে।

তাই তিনি মেয়েকে সাইকেলের পিছন থেকে সামনে এনে কোলের ভিতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেন,

— মা, তুমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকো। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।

তারপর রমিজ মিয়া কোন রকমে সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকেন।


মেহগনি বাগানটা পেরোতেই এখন খোলা মাঠের ভিতর দিয়ে রাস্তা ।রমিজ মিয়া সাইকেল নিয়ে মেয়েকে জাপটে ধরে দৌড়াচ্ছেন ঠিক তখনই দেখতে পান সামনেই পুরো রাস্তা জুড়ে সাদা কাফন পরা একটা লাশ শুয়ে আছে। এটা দেখে অনেক ভয় পেয়ে যান তিনি।তবে তাকে যে ভয় পেলে চলবে না। তাকে যে ভাবেই হোক বাসায় পৌঁছাতেই হবে।রমিজ মিয়া আবারও মেয়েকে বলেন,

— মা, আমি না বলা পর্যন্ত কিন্তু তুমি চোখ খুলবেনা।

এরপর রমিজ মিয়া লক্ষ্য করেন লাশটার পাশ দিয়ে সামান্য একটু জায়গা আছে যেখান দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কোন রকমে চলে যাওয়া যাবে। রমিজ মিয়া সাইকেলে উঠে সেই লাশটার পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে সাইকেল নিয়ে পাশ কাটাতেই প্রচন্ড পচা পচা গন্ধ পান।

মেয়েটাও তার গন্ধ পেয়ে বলে,

— বাবা এটা কিসের গন্ধ ?

রমিজ মিয়া বলেন,

— ও কিছু না মা। তুমি চোখ বুজে থাকো।

রমিজ মিয়া আর একটু সামনে যেতেই পিছন থেকে তার বৌয়ের গলায় ডাক শুনতে পান।

ডাক শুনেই তার মেয়ে বলে,

— বাবা, মা তোমাকে ডাকছে, মাকেও আমাদের সাথে নিয়ে চলোনা।

রমিজ মিয়া আবার মেয়েকে বলেন,

— নিয়ে যাচ্ছি, তবে তুমি কিন্তু চোখ খুলবে না আমি না বলা অবধি।


এভাবে জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে রমিজ মিয়া তার গ্রামের রাস্তায় চলে আসেন। সেখান দিয়ে যেতে যেতে দেখেন,

পাশের বাশ বাগানের ভিতর থেকে সেই মাথা কাটা লাশটা হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। রমিজ মিয়া আরো জোরে জোরে সাইকেল চালাতে চালাতে তার বাড়ির কিছুটা কাছে আসতেই একটা লোককে দেখতে পান। তাকে দেখতেই যেন প্রাণ ফিরে

পেলেন রমিজ মিয়া। তাড়াতাড়ি লোকটার কাছে চলে যান এবং তাকে তার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে বলেন।


পথে লোকটাকে রমিজ মিয়া ঘটনাটা বললে

লোকটা তাকে বলে,

— আমিতো মাঝে মাঝেই অনেক রাতে এ পথ দিয়ে যাই।

তবে কোনদিন তো কিছু দেখিনি। হয়ত লাশ কবর দিয়ে এসেছেন তাই এমন হয়েছে।

একথা বলেই বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে লোকটি চলে যায়।

ঘরে ঢুকে রমিজ মিয়া লক্ষ্য করেন তার মেয়ের গা দিয়ে কেমন যেন পচা গন্ধ বের হচ্ছে। তিনি ভাবেন,

হয়ত কবরের ভিতর পরে যাওয়ার কারণে এমন হয়েছে।

রমিজ মিয়া তার মেয়েকে বলেন জামা কাপড় খুলতে কারণ তাকে গোসল করতে হবে।

বাবার কথা মতো তাহেরা জামা খুলতেই মেঝেতে একটা ছোট্ট হাড়ের টুকরো পরে যায়। হাড়ের টুকরোটা দেখে সেটা হাতে নিয়ে রমিজ মিয়া বলেন,

— মা, তুমি এটা কোথায় পেলে !

তাহেরা বলে,

— সে যখন কবরের ভিতর পরে গিয়েছিল তখন তার গায়ের উপর এটা পড়েছিল।

আর তখনই সে এটা নিয়ে পকেটে রেখেছিল পরে এটা দিয়ে খেলা করবে বলে।

মেয়ের কথা শুনে রমিজ মিয়া প্রচন্ড রাগে মেয়েকে অনেক বকাঝকা করেন।

আর তাড়াতাড়ি পাশের বাড়ির হুজুরের কাছে চলে যান।


হুজুরটি সব শুনে রমিজ মিয়ার থেকে হাড়টি নিয়ে তাকে এক গ্লাস পানি পড়া দেন আর বলেন,

— এটা একটা আঙুলের হাড়। আর এই হাড়টি তোমার মেয়ের সাথে আনার কারণেই পথে তোমাদের সাথে এমনটা হয়েছে। আর তুমি যদি পথে সেই সময় তোমার মেয়েকে চোখ বন্ধ করে না রাখতে বলতে তবে তোমার মেয়ে সেটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেতো এমনকি অনেক বড় ক্ষতি ও হতে পারতো।


সব শুনে রমিজ মিয়া সেই পড়া পানি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। তবে ঠিক সেদিন রাতেই রমিজ মিয়া স্বপ্ন দেখেন যে,

তার চাচা শ্বশুরের কবরের পাশের কবরের উপর দাড়িয়ে সেই গলাকাটা লাশটা তাকে বলছে,

” তোর অনেক সাহস, যে কারণে তোর মেয়েকে নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারলি। না হলে তোর মেয়েকে আর জ্যন্ত ফিরে পেতি না”


কেমন হয়েছে বলবেন?


Writer: Md. Arafat Hossain 

ভৌতিক সমগ্র 1


 হোক নির্জন , ভাড়া কম আর চাপ কল আছে, পানির সমস্যা হবেনা। ঢাকা শহরের যে পানির সমস্যা তাতে এটাই উত্তম।

রায়হান, তুমি এমন বাসা কি করে পছন্দ করছো মাথায় আসছেনা। চলো ঢাকায় ফিরে যাই।

ফিরে যাই বললেই তো হবেনা। এখানে বদলি করা হয়েছে আমাকে, ইচ্ছে করে আসিনি। আসলে সৎ পুলিশ অফিসারদের দেশে কোন মূল্য নেই বরং সততার উপহার হলো বদলি। তাই বলে এমন নির্জন জায়গা বেছে নিতে হবে? কাছেপিঠে তেমন ঘরবাড়িও নেই যে, বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসবে।

আমার বেতনের কথাও তো চিন্তা করবে নাকি ? এক কাজ করো, একটু লোকালয়ে বাসা খোঁজো, দরকার পড়লে টিনসেড ঘরে থাকবো তবুও এমন বাসায় না।

নিরু তুমি বুঝতে পারছোনা কেন, এক মাসের এডভান্স দিয়ে দিয়েছি, আর সব গুছিয়ে আনতে পকেট ফাকা। এখন নতুন বাসায় ওঠা সম্ভব নয় অন্তত এই মাসটা। তোমার ভালো না লাগলে সামনের মাসেই নতুন বাসা খুঁজে নেবো, ঠিক আছে?

..

রায়হানের কথায় নিরু আর কিছুই বলেনা চুপচাপ ঘর গুছানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়িটা অনেকটা বাগানবাড়ির মতো তবে বেশ ছোট আর নিরিবিলি।


 দুইটা রুম,রান্নাঘর আর একটি বাথরুম। সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা নেই সব কাজ চাপ কল থেকে পানি টেনেই করতে হবে এসব ভেবে আরো কিছুটা বিরক্ত হলো তবুও আর কিছুই বললোনা।


 রান্নাঘরটা নিরুর বেশ পছন্দ হলো, জানালা খুলেই পুকুরের শীতল হাওয়া চোখেমুখে লাগতেই সারাদিনের খারাপলাগাটা ভালোলাগায় পরিণত হলো।


বাড়িরপেছনেই এতো সুন্দর পুকুর দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো ওর। বেশ নির্জলা টলটলে পানি। হালকা নীলাভ। দেখে মনে হয় আকাশ এসে ছুঁয়ে দিয়ে তার নীলিমায়


পুকুরের পানিকে ভরিয়ে তুলেছে। রায়হান আর নিরু সারাদিন কষ্ট করে নতুন করে সংসার সাজালো, সেদিন আর অফিসে গেলোনা রায়হান।

…..

পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে রায়হান অফিসে চলে যেতেই , নিরু দুপুরের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে গেলো। নির্জন বাড়িতে ও ছাড়া আর কোন প্রাণী নেই।


 এমন নির্জন জায়গায় বাড়িটি যে বানিয়েছে সে কেন থাকতে পারলো না কে জানে! হয়তো নির্জনতা তার আর পছন্দ হয়নি। একটি কুকুর বিড়ালও ওর নজরে আসেনি কাল থেকে।


কাটাকুটি করতে করতে ভাবলো রায়হান এলে একজন ছুটো কাজের বুয়া খুঁজতে বলবে, অন্তত একা একা দিন কাটাতে হবেনা। আনমনে রান্না চাপিয়ে দিলো।


 রান্না করতে করতে হঠাৎ মনে হলো পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে। ঝট করে মাথা ঘুরাতেই দেখলো কেউ নেই তবে কেন জানি মনে হলো কেউ একজন ছিলো। গ্যাসের চুলা বন্ধ করে সমস্ত বাড়ি ঘুরে এলো, কোথাও কেউ নেই। মনের মধ্যে খচখচানি নিয়েই রান্নাঘরে ফিরে এলো। সেদিন সারাদিন মনে হলো কেউ ওকে দেখছে। কেউ ওর আশেপাশেই আছে অথচ ও দেখতে পাচ্ছেনা। সন্ধ্যায় রায়হান ফিরে এলে ওকে কিছুই বললনা, বললে হয়তো হাসবে। রাতে খাবার সময় শুধু বলল, আমার একা একা কেমন যেন অসস্থি লাগে, তুমি একজন ছুটো বুয়ার খোজ করবে?


রায়হানের কেন জানি মনে হলো কথাটি বলতে গিয়ে নিরুর গলা খানিকটা কেঁপে উঠলো কিন্তু নিরুর চেহারা বেশ স্বাভাবিক তাই আর গুরুত্ব দিলোনা, শুধু বলল, হুম কাল খোঁজ করবো।

..

পরদিন রায়হান চলে যেতে আবারো নিরু একাকী হয়ে পড়লো। আজ মোটেই কাজে মন বসাতে পারছেনা। কালকের অনুভূতি টা ফিরে এসেছে। শুধু মনে হচ্ছে কেউ আছে, কেউ একজন খুব কাছেই আছে কিন্তু সে ধরা দিচ্ছেনা। এসব ভাবতেই নিজে নিজেই শিউরে উঠলো। নিরুর মনে হচ্ছে একাকীত্ব ওকে চেপে ধরছে, নিশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। জোর করে মন থেকে ওসব ভাবনা দূরে ঠেলে কাজে মন দিলো। কারো উপস্থিতি আর তেমন পাত্তা দিতে ইচ্ছে হলোনা ওর। পাত্তা দিলেই ভয় মনে চেপে বসছে যেন। হঠাৎ কেমন অসস্থি গরম অনুভূত হলো। খেয়াল করলো আজ রান্নাঘরের জানালাটি খুলা হয়নি। এজন্যই হয়তো গরম লাগছে ভেবে জানাটি খুলতে গেলো।


 জানালাটি খুলেই বেশ অবাক হলো নিরু। ওর দিক পেছন ফিরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় নীল সাথে চিকণ কালো পেড়ে শাড়ি পড়া। আঁচলটি মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাথায় একরাশ কালো কেশ পিঠ বেয়ে মাজায় এসে ঠেকেছে। দু’হাত ভর্তি নীল রেশমি কাঁচের চুড়ি। রেশমি চুড়ি পড়া হাতটি দেখে দিব্বি বলে দেওয়া যায় এ মেয়েটি বেশ রুপবতী। তবে নিরুর কেন জানি মনে হচ্ছে পেছন থেকে যেন ও নিজেকেই দেখছে।


এই প্রথম এ বাড়ির আশেপাশে মানুষের দেখা পেয়ে নিরুর বেশ আনন্দ হলো।

এই যে শুনছেন, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? নিরু কয়েকবার ডাকলো অথচ এতো কাছে দাঁড়িয়েও মেয়েটি যেন কিছুই শুনতে পেলো না। নিশ্চল দাঁড়িয়ে। নিরু সাত পাঁচ না ভেবে পুকুরপাড়ে যাবে বলে পা বাড়ালো। বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেলো, কেউ নেই। আশপাশ ভালোভাবে তাকিয়ে কারো ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলোনা।

 এতো দ্রুত কারো পক্ষে এভাবে দৃষ্টির আড়াল হওয়া খানিকটা অসম্ভব। কারন পুকুরের একপাশে খোলা বিস্তৃত মাঠ আর অন্যপাশে জংলা। আর জংলাটাও বেশ কিছুটা খোলা জায়গা পার হয়ে যেতে হয়। নিরুর আসতে বড়জোর মিনিট দুই তিন লেগেছে আর এই সময়ের মধ্যে এভাবে হাওয়া হয়ে যাওয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। তবে কি..


নিরু আর ভাবতে পারলো না গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। ফিরে আসতে উদ্যত হতেই চোখের কোনে চিকচিক করে উঠা কোন জিনিষের অস্তিত্ব অনুভূত হলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। স্বচ্ছ পানিতে রোদ পড়ায় পানির নিচে কিছু একটা ঝিলিক দিচ্ছে, বসে হাত বাড়িয়ে পানির নীচ থেকে তুলে আনলো, অবাক হয়ে দেখলো একগুচ্ছ নীল রেশমি চুড়ি, ঠিক যেমনটি মেয়েটির হাতে ভর্তি ছিলো। আবারো এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করলো মেয়েটিকে কিন্তু না, কোথাও তার ছায়াটি পর্যন্ত নেই।


একবার ভাবলো চুড়ির গুচ্ছ পানিতে যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে দেবে কিন্তু কি এক আকর্ষণে নিরু রাখতে পারলোনা। সাথে করে নিয়ে এসে সযত্নে তুলে রাখলো।


রাত দুইটা, রায়হানের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, পাশে হাত দিতেই বুঝতে পারলো নিরু পাশে নেই। ভাবলো হয়তো বাথরুমে গেছে, কিন্তু হঠাৎ মনে হলো বাথরুমে থাকলে তো দরজার নিচ দিয়ে আলো দেখতে পাওয়ার কথা কিন্তু বাথরুমে আলো জ্বলছেনা তার মানে নিরু বাথরুম এ নেই। উঠে বসতেই দেখলো বেডরুম এর দরজা খোলা। এগিয়ে গিয়ে পাশের রুমে, বারান্দায় সবখানে খুঁজে এলো কিন্তু নিরুকে দেখতে পেলোনা। হঠাৎ মনে হলো রান্নাঘরে খুঁজা হয়নি। ছুটে গেলো রান্নাঘরে, ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। লাইট জ্বালাতেই দেখতে পেলো রান্নাঘর ফাকা নিরু নেই। কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। লাইট অফ করতে যেতেই মনে হলো রান্নাঘরের জানালাটি খুলা। এগিয়ে গিয়ে জানালার পাল্লায় হাত দিতেই চমকে উঠলো। নিরু দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পাড়ে। চাঁদের আলোয় বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।


এই নিরু…..নিরু….. এতো রাতে ওখানে কি? ফিরে এসো।


রায়হানের মনে হলো নিরু একবার পেছন ফিরে চেয়ে আস্তে আস্তে পুকুরের পানিতে নেমে যাচ্ছে। রায়হান চমকে উঠলো, নিরু সাঁতার জানেনা। নিরুর ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়া দেখে রায়হান চিৎকার দিয়ে উঠলো।

..

হঠাৎ কারো ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরে পেলো, তাকিয়ে দেখলো নিরু ওর সামনে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রায়হান আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ও ওর বেডরুমেই আছে, আর প্রচন্ড ঘামছে।

— তুমি কি স্বপ্ন দেখেছো?

— হুম, হয়তো, তবে প্রচন্ড ভয়ংকর।

— ও কিছুনা, পানি খেয়ে শুয়ে পড়ো, রাত দুইটা বাজে, সকালে উঠতে হবে। নিরুর কথা শুনে রায়হান কিছুটা চমকে উঠলো, ওর স্বপ্নের শুরুও যে রাত দুইটা!!

……

আজ দুপুর থেকেই প্রকৃতি বেশ থমথমে, আকাশে মেঘ জমা হচ্ছে, মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে আসছে। বারান্দায় বসে সকালের কথা মনে করছে নিরু, আজ সকালে রায়হান চলে যেতেই দরজায় এক বুড়ি এসে দাঁড়ায়, বুড়ির চুলগুলি জট ধরা, দেখেই নিরুর বুক কেঁপে উঠেছিলো। তবুও এগিয়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিলো কি চায়।

 বুড়ি একদৃষ্টে কিছুক্ষণ নিরুর দিক তাকিয়ে হঠাৎ হেসে উঠে বলেছিলো, তোকে চাইরে তোকে… আজই চাই..


নিরু আবারো কেঁপে উঠেছিলো, দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু বাহিরে বেশ কিছুক্ষণ বুড়ি দাঁড়িয়ে হেসেছিলো, সেই হাসি নিরুর সমস্ত শরীরে কাটা তুলে দিচ্ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো, বৃষ্টি নিরুর খুব প্রিয়। বৃষ্টি এলেই কেন জানি নীল শাড়ি পড়ে ভিজতে ইচ্ছে করে। নিরু উঠে গিয়ে খুব যত্ন করে একটি নীল শাড়ি পড়লো, চোখে গাঢ় করে কাজল নিলো। হঠাৎ পুকুর থেকে তুলে আনা চুড়ির কথা মনে হতেই চুড়ি গুলি বের করে হাত ভর্তি করে পড়ে নিলো।


আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ খুটে খুটে কিছুক্ষণ দেখলো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ নিরুকে, আজ রায়হান থাকলে নির্ঘাত নতুন করে প্রেমে পড়তো, কথাটি ভাবতেই নিরুর ঠোটের কোনে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো।

নিরু ভিজছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোটা সাথে ঝড়ো হাওয়া সে এক অন্য রকম অনুভূতি। ভিজতে ভিজতে কখন যে পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। আজও মেয়েটি দাঁড়িয়ে, সেই একই শাড়ি পড়ে একই সাজে। নির্বাক হয়ে পুকুর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। নিরু কিছুটা এগিয়ে যেতেই মেয়েটি নিরুর দিকে ফিরে চাইলো।


নিরু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো, এ যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন এক নীল অপ্সরী। নিরুর তাকিয়ে থাকা দেখে মেয়েটি হেসে উঠে বললো, বৃষ্টিতে কখনো পুকুরে স্নান করেছো?

নিরু মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো, না।

মেয়েটি বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললো, পুকুরের জলে বৃষ্টিস্নান, দারুণ লাগে, এসো আজ আমরা পুকুরের নীল জলে নেমে বৃষ্টিস্নান করি।

নিরু দু পা পিছিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে বললো, আমি সাঁতার জানিনা।

মেয়েটি আবারো হাসলো, এবার তার হাসির ভেতর বেশ আশ্বাস খুঁজে পেলো, সেই হাসি যেন নিরুকে বলছে, ভয় নেই আমি আছি। মেয়েটির বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে চেয়ে কি যেন ভেবে এগিয়ে গেলো। মেয়েটির হাতে হাত রাখতেই নিরুর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো, ওর মনে হলো একখণ্ড বরফ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


মেয়েটি আবারো হেসে উঠলো, তবে এ হাসির অর্থ নিরু খুঁজে পেলো না। শুধু মনে হলো আজ ও পুকুরের নীল জলে করবে বৃষ্টিস্নান।


উত্তাল প্রকৃতি অবাক হয়ে দেখছে নীল শাড়ি পড়া দুটি রমণী ধীরে ধীরে পুকুরের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে আর তাদের আঁচল যেনো বিছিয়ে আছে সমস্ত পুকুর জুড়ে ।


তাদের এই বৃষ্টিস্নানের সাক্ষী আজ ঝড়ো হাওয়া, ঝড়ো হাওয়ায় দোদুল্যমান গাছপালা আর মেঘে ঢাকা আকাশ।

…..

রায়হান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা চল্লিশ। মেঘের ঘনঘটায় বাহিরে বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব। বোঝা যাচ্ছে আজ প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি নিরুর খুব পছন্দ। বৃষ্টি দেখলেই নিরু নীল শাড়ি পড়ে বৃষ্টিতে ভেজে। নিরুর বৃষ্টিতে ভেজা দেখতে রায়হানের বড্ড ভালো লাগে, মনে হয় একটি নীল পরী বৃষ্টির পানিতে নেচে বেড়াচ্ছে। নিরুর বৃষ্টিতে ভেজা দেখে প্রতিবারই যেন নতুন করে প্রেমে পড়ে রায়হান তবে নিরু এটা হয়তো জানেনা আর জানার কথাও না কারন কখনওই নিরুকে বলা হয়নি সে কথা।


এসব ভাবতে ভাবতেই শাড়ির দোকানে ঢুকে পড়লো রায়হান, আধ ভেজা হয়ে । ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বেছে বেছে গাঢ় নীল আর কালো পেড়ে একটি শাড়ি রায়হানের বেশ মনে ধরলো। দোকান থেকে বেরিয়ে মনে হলো নীল রেমশি চুড়ি নিতে পারলে দারুণ হতো, বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দের সাথে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ মিলে এক


মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হবে, ভাবতেই ভালো লাগছে। চুড়ির দোকান খুঁজে পেতে বেশ কিছুটা সময় চলে গেলো। নিজের জন্য একটা নীল শার্ট ও নিয়ে নিলো। আজ নিজেও ভিজবে নিরুর সাথে । নিরু কখনো পুকুরের পানিতে নেমে বৃষ্টিতে ভেজার স্বাদ নিতে পারেনি। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় যখন পুকুরে অর্ধেক শরীর ডুবে থাকে আর বাকি অর্ধেক ভেজে বৃষ্টিধারায়। ডুব দিয়ে থাকলেও বৃষ্টির যে ফোটা গুলি পানিতে পড়ে সেও এক অন্যরকম অনুভূতি। এসব অনুভূতি আজ অনুভব করাবে নিরুকে সাথে আজ বলবে প্রতিটি বৃষ্টি ভেজা দিনে রায়হান নতুন করে নিরুর প্রেমে পড়ে। আজ নিরুকে নিয়ে রায়হান সমস্ত পুকুর সাঁতরে বেড়াবে। নীল শাড়ি পড়া এক অপূর্ণ সুন্দরি রমণী সাথে নীল শার্ট পড়া তার প্রেমিক পুরুষ, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে নীলাভ পানিতে হাত ধরে ভাসছে। কি অপরূপ দৃশ্য, ভাবতেই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো । সাথে কিছুটা ভয় , কেনাকাটা করতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, যেতে যেতে বৃষ্টি না থেমে যায়! তবে যে সকল আয়োজন ব্যর্থ। আকাশ পানে তাকিয়ে দেখলো সমস্ত আকাশ জুড়ে এখনো কালো মেঘেরঘটা, খুব শীঘ্রই এই বর্ষণ থামবে বলে মনে হচ্ছেনা। হঠাৎ মন কুহু ডেকে উঠলো, কেন জানি মনে হচ্ছে এ বর্ষণ


সর্বনাশা!!

…..

জীপ থেকে নেমেই এক দৌড়ে বারান্দায় উঠলো, যেন নিরু পড়ার আগে শাড়িটি ভিজে না যায়। দরজা হালকা টেনে দেওয়া, দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নিরু নিরু বলে বার কয়েক ডেকে খুঁজতে লাগলো কিন্তু নিরুর কোন সাড়াশব্দ নেই। রান্নাঘরে উকি দিতেই দেখে জানালাটি হাট হয়ে খোলা আর বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে গ্যাসের চুলা ভিজিয়ে দিচ্ছে।

দ্রুত এগিয় গেলো জানালা বন্ধ করবে বলে। জানালার সামনে এসে অবাক হয়ে দেখলো, পুকুরের পানি আজ বড্ড বেশি নীল লাগছে। ঠিক ওর কিনে আনা গাঢ় নীল শাড়ির ন্যায়। মনে হচ্ছে নিরু নীল শাড়ি পড়ে মাঝ পুকুরে ভাসছে আর ওর আঁচল বিছিয়ে আছে সমস্ত পুকুর জুড়ে।


 কি অপরূপ লাগছে আজ পুকুরের নীল জল!


রায়হান অপলক তাকিয়ে আছে সেদিকে। 


"বাড়িটা বড্ড নির্জন" 


Writer: Md. Arafat Hossain